- 26 February, 2022
- 0 Comment(s)
- 532 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
মহিলারাও কখনো-সখনো প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। ভালো লাগুক বা মন্দ লাগুক, প্রায়শই তাঁরা ‘ডল্স্ হাউজ’-এর নোরার মতো মেনে নেন যে, স্বামীরাই তাঁদের হয়ে চিন্তা করবেন; স্বামীরাই হবেন দম্পতির বিবেক। ভীরুতা, অবিচক্ষণতা, অলসতা থেকে স্বামীদের ওপরই তাঁরা ছেড়ে দেন যে-কোনো সাধারণ এবং বিমূর্ত বিষয়ে উভয়ের একই মতামত গঠনের বিষয়টি। পনেরো বছর ধরে নিজের চেয়ে স্বামীকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে গণ্য করে আসা একজন বুদ্ধিমতী, সংস্কৃতিসম্পন্না, স্বাধীন নারী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর কী পরিমাণ বিভ্রান্তির সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন--স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নিজেই বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর বিশ্বাস এবং আচরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। প্রতিটি পরিস্থিতিতে তাঁর স্বামী কী ভাবতে পারতেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন--সেটা তিনি এখনও অনুমান করার চেষ্টা করেন। স্বামীরা সাধারণত পরামর্শদাতা এবং নেতার ভূমিকায় আনন্দিত হন। সমকক্ষদের সঙ্গে কাজ করার অসুবিধা এবং ঊর্ধ্বতনদের প্রতি আনুগত্যের পর সন্ধ্যাবেলায় নিজেদেরকে তাঁরা পরম উচ্চতর ভাবতে পছন্দ করেন। পছন্দ করেন অবিসংবাদিত সত্যগুলি বিতরণ করতে। স্ত্রীর কাছে তাঁরা দিনের ঘটনাধারার উল্লেখ করেন, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেকে সঠিক প্রতিপন্ন করেন। স্ত্রীর মধ্যে নিজের একটি অবিকল প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়ে তাঁরা খুশি হন, যেহেতু তা তাঁদের আত্মবিশ্বাসকেই সুনিশ্চিত করে। সংবাদপত্র এবং নতুন নতুন নীতি বা রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন। খুশি হয়েই তিনি সেগুলি জোরে জোরে পড়েন যাতে সংস্কৃতির সঙ্গে স্ত্রীর স্বাধীন যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে না-ওঠে। নিজের কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য নিজের আনন্দমতো তিনি নারীসুলভ অক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করেন। কম-বেশি বাধ্যতার সঙ্গেই এই অধস্তন ভূমিকাকে গ্রহণ করে নেন স্ত্রী। আমরা জানি স্বামীর অনুপস্থিতিতে আন্তরিকভাবে অনুশোচনাকারী মহিলারা কী বিস্ময়কর আনন্দের সঙ্গে সেই সুযোগেই আবিষ্কার করেন সন্দেহাতীত সম্ভাবনাগুলিকে। তাঁরা ব্যাবসাপত্র চালান, সন্তান লালন-পালন করেন, সিদ্ধান্ত নেন এবং কোনো সাহায্য ছাড়াই সব কিছু পরিচালনা করেন। স্বামীরা ফিরে আসার পর যখন আবার অযোগ্যতার শিকার হন--তখনই বরং তাঁরা কষ্ট পান।
বিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করে একটি খামখেয়ালী সাম্রাজ্যবাদের দিকে : আধিপত্যের প্রলোভন সেখানে সবচেয়ে সর্বজনীন, সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য।সন্তানকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া, স্ত্রীকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ সেখানে হল পৃথিবীতে অত্যাচারের চাষ করা। প্রায়শই দেখা যায়, সমর্থিত এবং প্রশংসিত হওয়া বা পরামর্শ দেওয়া এবং পথ দেখানোই স্বামীর কাছে যথেষ্ট নয়।তিনি আদেশ করেন। সার্বভৌমত্বর অভিনয় করেন। তাঁর শৈশবকালের সমস্ত ক্ষোভ, যে-সমস্ত অন্য পুরুষের অস্তিত্ব তাঁকে উত্ত্যক্ত এবং আঘাত করে তাঁদের থেকে সারাজীবনের প্রত্যেক দিনের জমা-হওয়া ক্ষোভ—সেই সমস্তই তিনি বাড়িতে অর্গলমুক্ত করেন স্ত্রীর কাছে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার মাধ্যমে। হিংসা, ক্ষমতা এবং ঠেঁটামির অনুকরণ করেন তিনি। কঠোর কণ্ঠে আদেশ দেন। অথবা চিৎকার করেন, টেবিলে চাপড় মারেন : স্ত্রীর কাছে এই কমেডি হল প্রতিদিনের বাস্তবতা। নিজের অধিকারসমূহের ওপর স্বামী এতটাই প্রত্যয়ী যে, স্ত্রীর দ্বারা সংরক্ষিত স্বল্প স্বায়ত্তশাসনই তাঁর কাছে বিদ্রোহ বলে মনে হয়। তাঁকে ছাড়া স্ত্রীকে শ্বাস নিতেও বাধা দিতে চান স্বামী। যদিও, স্ত্রীও বিদ্রোহ করেন। এমনকি, স্বামীর পুরুষালী মর্যাদা বা খ্যাতি-প্রতিপত্তিকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে স্ত্রীর জীবন শুরু হলেও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এই চোখ-ধাঁধানো ভালোলাগা দ্রুতই বিলীন হয়ে যায়। সন্তান একদিন বুঝতে পারে যে, গুরুত্বের দিক দিয়ে তার বাবা গৌণ। শীঘ্রই স্ত্রী আবিষ্কার করেন যে, তাঁর সামনে কোনো উচ্চব্যক্তিত্ব সামন্ত প্রভু, প্রধান বা গুরু নেই। আছেন একজন সাধারণ পুরুষ। স্বামীর দাসত্ব করার কোনো কারণই স্ত্রী দেখতে পান না। স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামী কেবল অকৃতজ্ঞ এবং অন্যায় কর্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। কখনও কখনও স্ত্রী নিজেকে মর্ষকামী আত্মতুষ্টির সঙ্গে অর্পণ করেন। শিকার-হওয়া ব্যক্তির ভূমিকা গ্রহণ করেন তিনি। স্ত্রীর এই আত্মসমর্পণ একটি দীর্ঘ নীরব তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে প্রায়শই তিনি তাঁর প্রভুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। স্বামীকেই উলটে অত্যাচার করার চেষ্টা করেন।
পুরুষেরা তখনই নির্বোধ হন, যখন তাঁরা কল্পনা করেন যে, নিজের স্ত্রীকে সহজেই তাঁরা নিজেদের ইচ্ছার বশীভূত করতে পারবেন এবং নিজেদের খুশিমতো তাঁদের ‘গঠন’ করতে পারবেন। বালজাক বলেছেন, “স্ত্রী হলেন যা তাঁর স্বামী তাঁকে তৈরি করেন”। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পরেই বালজাক এর বিপরীত কথা বলেন। বিমূর্ততা এবং যুক্তির ক্ষেত্রে স্ত্রীরা প্রায়শই পুরুষালি কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু যখন ধারণা এবং অভ্যাসের কথা আসে--যা সত্যিসত্যিই স্ত্রীদের হৃদয়ের কাছাকাছি--স্ত্রী তখন স্বামীর বিরোধিতা করেন প্রচ্ছন্ন জেদের সঙ্গে। শৈশব এবং যৌবনের প্রভাব স্বামী অপেক্ষা স্ত্রীর মধ্যে অনেক বেশি, কারণ স্ত্রীরা তাঁদের ব্যক্তিগত ইতিহাসে অনেক বেশি আবদ্ধ থাকেন। সেই সময়কালে স্ত্রী যা অর্জন করেছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি সেখান থেকে মুক্তি পান না। স্ত্রীর ওপর স্বামী চাপিয়ে দেবেন রাজনৈতিক মতামত। যদিও স্ত্রীর ধর্মীয় বিশ্বাসকে তিনি সংশোধন করবেন না, স্ত্রীর কুসংস্কারগুলিকেও তিনি ঝেড়ে ফেলবেন না : এমনটাই লক্ষ করেছেন জঁ বারোয়া, যিনি কল্পনা করেছিলেন যে তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকা ছোটো ধর্মপ্রাণ মূর্খের ওপর সত্যিকারের প্রভাব অর্জন করবেন। হতাশার সঙ্গে তিনি বলেছিলেন : “একটি ছোট্ট মেয়ের মস্তিষ্ক, একটি প্রাদেশিক শহরের ছায়ায় সংরক্ষিত : অজ্ঞ মূর্খতার সমস্ত প্রমাণ : এটি মুছে যায় না”।
স্বামীর কাছ থেকে শেখা মতামত, তোতাপাখির মতো আওড়ে-চলা নীতিমালা সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রতি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেই স্ত্রী রক্ষা করে চলেন। এই প্রতিরোধই তাঁকে তাঁর থেকে বুদ্ধিমান স্বামীকে বুঝতে অক্ষম করে তোলে। অথবা, বিপরীতে, নিজেকেই তিনি পুরুষালী গাম্ভীর্যের ওপরে তুলে ধরবেন--যেমনটা হয়েছিল স্টেনডাল বা ইবসেনের নায়িকাদের ক্ষেত্রে। হয় স্বামী তাঁকে যৌনভাবে হতাশ করেছেন বলে, অথবা স্বামী তাঁর ওপর কর্তৃত্ব করায় তিনি প্রতিশোধ নিতে চান বলে--কখনো-সখনো স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে স্ত্রী এমন মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরেন যা তাঁর স্বামীর নিজস্ব মূল্যবোধ নয়। স্বামীকে পরাজিত করার জন্য স্ত্রী তখন তাঁর মা, বাবা, ভাই, চার্চে যিনি অপরাধ স্বীকার করান সেই ব্যক্তি, বোন অথবা কোনো পুরুষ ব্যক্তিত্বের কর্তৃত্বের ওপর নির্ভর করেন, যাঁকে তাঁর নিজের চেয়ে ‘উচ্চতর’ বলে মনে হয়। অথবা ইতিবাচক কিছু দিয়ে তাঁর বিরোধিতা না-করে, নিয়মিতভাবে স্বামীর বিরোধিতা করে চলেন স্ত্রী। স্বামীকে আক্রমণ করেন, আঘাত করেন। স্বামীর মধ্যে হীনমন্যতাবোধ তৈরির চেষ্টা করেন তিনি। অবশ্যই, স্ত্রীর যদি প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে, স্ত্রী তাহলে আনন্দ পান স্বামীকে ছাড়িয়ে যেতে, স্বামীর ওপর নিজের মতামত, পর্যবেক্ষণ, নির্দেশাবলী চাপিয়ে দিতে। সমস্ত নৈতিক কর্তৃত্বই দখল করবেন তিনি। যে-সমস্ত ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর বৌদ্ধিক শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, সেই সব ক্ষেত্রে স্ত্রী চেষ্টা করেন যৌনতার দিক থেকে প্রতিশোধ নিতে।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment